![]() |
প্রত্নতত্ত্ব মানেই মাটি খোঁড়া৷ কখনো সেটা দুর্গম গভীর জঙ্গলে, কখনো মরুভূমিতে, আবার কখনো ধূ-ধূ প্রান্তরে৷ প্রত্নতাত্ত্বিকেরা বিশ্বাস করেন, অতীত সভ্যতার খুব সামান্যই আজ পর্যন্ত আবিষ্কৃত হয়েছে৷ তাই নিরন্তর তারা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন তার খোঁজে৷
কিন্ত্ত খুঁজবেন কীভাবে, বেশির ভাগই তো সময়ের সঙ্গে-সঙ্গে তলিয়ে গেছে মাটির তলায়, যার প্রায় কোনো চিহ্নই বোঝা যায় না উপর থেকে৷ ফলে, মাটি খুঁড়ে যে সেই সভ্যতার চিহ্ন বের করে আনা হবে তার কোনো সহজ উপায়ও নেই৷ অন্ধকারেই ঢিল ছুঁড়ে যেতে হয়৷ এমনও হয়েছে, ইতিহাস-ভূগোল ঘেঁটে হয়তো অনুমান করা হয়েছে এখানে কিছু পাওয়া যাবে, পরে বিস্তীর্ণ এলাকা খনন করে পাওয়া যায়নি কিছুই৷

এই প্রসঙ্গে বলে রাখা ভালো, এই ধরনের প্রত্নতাত্ত্বিক খনন কার্য বেশ ব্যয়বহুল৷ এর বাইরে আরো এক সমস্যা হয়তো দেখা গেলো, যে স্থানটা চিহ্নিত করা হয়েছে খননের জন্যে সেই স্থান কোনো ব্যক্তি-মালিকানার৷ তখন নিশ্চিত না হয়ে খনন কাজ শুরু করাটাই বিপজ্জনক৷
প্রত্নতাত্ত্বিকদের হাতে এই মুহূর্তে যে-আধুনিক অস্ত্রটি এসেছে সেটি হল `স্যাটেলাইট আর্কিওলজি`৷ কোনো কোদাল-বেলচা ছাড়াই, উপগ্রহের সাহায্যে পাওয়া যাচ্ছে মাটির তলায় লুকিয়ে থাকা প্রাচীন কোনো শহরের চিহ্ন এবং চেহারা৷ মাটি থেকে চারশো মাইল উপরে ভেসে থাকা উপগ্রহ নিরন্তর এমন সব ছবি তুলে চলেছে যা বিশ্লেষণ করে জেনে নেওয়া যাচ্ছে মাটির তলার হুবহু ল্যান্ডস্কেপ৷ এতটাই হুবহু যে চমকে যাওয়ার মতো৷ অনেকটা চিকিৎসা বিদ্যায় স্ক্যানিং পদ্ধতি যেভাবে শরীরের ভিতরটা দেখতে সাহায্য করে প্রায় তেমনই৷ এই সব স্যাটেলাইট ইমেজ প্রত্নতাত্ত্বিকদের নিরন্তর দেখিয়ে চলেছে হারিয়ে যাওয়া নদী, প্রাচীন রাস্তা কিংবা নগর৷

ফলে, পৃথিবীর প্রত্যন্ত এবং দুর্গম এলাকায় না গিয়েই আপনি নিরাপদ দূরত্বে থেকেই বুঝতে পারছেন মাটির তলার চেহারাটা৷ আপনি বাড়িতে বসেই আফ্রিকার দুর্গম অঞ্চলের মাটির তলার চেহারাটা পেয়ে যাচ্ছেন এইভাবেই। বার্মিংহামের ইউনিভার্সিটি অফ অ্যালাবামার প্রত্নতাত্ত্বিক সারা পারকাক এই স্যাটেলাইট-আর্কিওলজিকে প্রায় হাতের মুঠোর মধ্যে নিয়ে চলে এসেছেন৷ মিশর নিয়ে তার এবং তার দলবলের কাজ৷
গত চার বছর ধরে তারা বিশ্লেষণ করে চলেছেন `নাইল ডেলটা`য় ৩ হাজার বছরের পুরানো নগর তানিসের উপগ্রহ ছবিকে৷ এবং ইতিমধ্যেই সেখানে মাটির তলায় চিহ্নিত করেছেন সম্ভাব্য ১৭টি পিরামিড, প্রায় ৩ হাজার মানুষের বসবাসের নগর৷ এবং সবটাই করেছেন অ্যালাবামা বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্কিওলজি ল্যাবে বসেই৷

সেখানে বসেই তৈরি করছেন তিন হাজার বছরের পুরানো নগরের একটি প্রামাণ্য ম্যাপ৷এতোটুকু খনন-কার্য না চালিয়েই৷ কীভাবে পাওয়া যায় এই উপগ্রহের ছবি? ইনফ্রারেড লেজার রশ্মি নিরন্তর উপগ্রহ থেকে আঘাত করতে থাকে নির্দিষ্ট এলাকায়৷ প্রতি চার-পাঁচ সেকেন্ডে কয়েক মিলিয়ন লেজার পালস ধাক্কা মারে মাটিকে এবং তারপর আবার ফিরে যায় উপগ্রহে রাখা সেনসরের কাছে৷ এই সেনসর হিসেব করে জানায় ঠিক কতটা পথ অতিক্রম করেছে এক-একটি পালস ফিরে আসতে৷ সেই কোটি-কোটি পথের হিসেব মিলিয়ে তৈরি হয় মাটির নীচের লুকিয়ে থাকা শহরের চেহারাটা৷ এমনকী থ্রি-ডি চেহারাও তৈরি করে নেওয়া যাচ্ছে।

মিশরের তানিস শহরের একটা অংশ বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে বেশ কিছু বড় বাড়ি একটা জায়গায় জড়ো হয়ে আছে, আর অনেক ছোট বাড়ি রয়েছে জড়ো হয়ে বেশ দূরত্বে৷ একটা জায়গায় একটি একা বাড়ি রয়েছে যার চেহারাটা অনেকটা উপাসনা গৃহের মতো৷ শুধুমাত্র এই চেহারা দেখেই তিন হাজার বছরের পুোনো এক শহরের সভ্যতার এবং সমাজ-ব্যবস্থার একটা আপাত-চেহারা পাওয়া যাচ্ছে এতোটুকু খনন কার্য না করেই৷ এরপর যদি প্রয়োজন হয়, তাহলে খনন-কার্য শুরু করা যেতে পারে৷
কিন্ত্ত স্পেস-আর্কিওলজি যে গুরুত্বপূর্ণ কাজটা এর পাশাপাশি খুব ভালোভাবে করে ফেলতে পারছে সেটা হলো, আকাশ থেকে নজরদারি চালিয়েই বুঝে ফেলা যচ্ছে প্রাচীন ধ্বংসাবশেষ মাটি খুঁড়ে চোরাই চালান কোথায়-কোথায় সংঘটিত হচ্ছে৷ আর সেই তথ্য পেয়ে সেই চোরা-চালান অনেকটাই বন্ধ করাও গেছে৷ ফলে, আধুনিক প্রত্নতত্ত্ব শুধু যে প্রাচীন নগর-পরিকল্পনার চেহারাই আমাদের হুবহু জানিয়ে দিচ্ছে তাই নয়, সেই নগরের বিবিধ মূল্যবান চিহ্ন যাতে বেহাত না হয়ে যায় সেই ব্যবস্থাও করে চলেছে প্রতিনিয়ত৷ আর বেহাত হলে, সভ্যতার ইতিহাস অসম্পূর্ণ থাকবে।

No comments:
Post a Comment