ফিসফাস শব্দে হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেলো ফারজাদের। গভীর রাতে তার কানের কাছে এ শব্দটি প্রায় বাজে। কোনো দিন শব্দটি খানিকটা তীব্র হয়। আজো তেমনি হলো। গভীর রাতে ফিসফাস শব্দে ঘুম ভেঙে গেলে গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। চোখ থেকে ঘুম পালিয়ে যায়। বুক ধড়ফড় করে। তখন হাত- পা নাড়ানোও কষ্টকর হয়ে যায়। চোখ খুলতেও ভয়।
ঈদানীং প্রায় এমন ঘটনা ঘটছে ফারজাদের। রাত যত গভীর হয় তার ভেতর ভয়ও ততটা দানা বাঁধতে থাকে। মাঝে মাঝে ভয় থেকে ঘুমও নামে না চোখের পাতায়। ভয় ঠেলে কখনো কখনো এপাশ ওপাশ করে। তখন রাতও ভীষণ দীর্ঘ হয়ে ওঠে। কোনো ভাবেই রাত শেষ হতে চায় না। পৃথিবীর সমস্ত ভয় যেনো তার পাশে এসে ঘুরঘুর করে। ভয় থেকে চোখ খোলার সাহসও হয় না। অথচ ফারজাদের বন্ধুরা বলে ও ভীষণ সাহসী। ওর নিজেরও বিশ্বাস ও সাহসীই। অথচ গভীর রাতে ফিসফাস শব্দে যখন ঘুম উধাও হয়ে যায় তখন তার মতো ভিতু আর কেউ বুঝি নেই। এ ভয়ের কী কারণ তাও সে বোঝে না।
প্রথম দিকে এমন শব্দ পাত্তাও দেয়নি ও। পয়লা এমন শব্দে ঘুম ভাঙলো যেদিন শোয়া থেকে দ্রুত উঠে পড়লো। খাটের পাশেই সুইচ বোর্ড। হাত বাড়িয়ে সুইচ চেপে দিলো। আলোয় ভরে উঠলো ওর কক্ষটি। প্রথম চোখ পড়ে দরজার দিকে। না দরজা আটকানোই আছে। কক্ষের চারপাশে নজর বোলায়। সবইতো ঠিক আছে। কোথাও কোনো অসঙ্গতি দেখছে না ও। তাহলে কি মনের ভুল। হয়তো হবে। এই ভেবে সুইচ অফ করে শুয়ে পড়লো সে। সুইচ অফ করতেই ভীষণ অন্ধকার জমে উঠলো তার কক্ষটিতে। এত অন্ধকার এর আগে ও কখনো খেয়াল করেনি। এই প্রথম ওর মনে হলো অন্ধকারেরও একটি আশ্চর্য ভার আছে। আবার আয়াতুল কুরসি পড়ে বুকে ফুঁ দিয়ে চোখ বন্ধ করলো। এ ভাবনা সে ভাবনা ভাবতে ভাবতে কখন ঘুমিয়ে গেলো মনে নেই। ভোরে ঘুম থেকে ওঠার পর থেকে সারাদিন স্কুল। খেলাধুলা। লেখাপড়া। রাতের ঘটনা ভুলে গেলো বিলকুল।
আবার রাত এলো। রাতের খাওয়া লেখাপড়া স্কুলের ব্যাগ গুছিয়ে ঘড়ি দেখে রাত ১২টার বেশি। এখন দাঁত ব্রাশ করে এক গ্লাস পানি খেয়ে শুয়ে পড়বে। এমনই রুটিন ফারজাদের। আজ কেন যেনো ব্রাশ করতে ইচ্ছে করছে না। করবে না সিদ্ধান্ত নিয়েই ভাবলো ভোরে ঘুম থেকে উঠেই ব্রাশ করে নেবে। টেবিলের কাগজপত্র গোছাতে গোছাতে চোখ গেলো টি-টেবিলের ওপর। দুধভর্তি গ্লাসটি টি-টেবিলে একটি পিরিচের নিচে দাঁড়িয়ে। আজ দুধ খাওয়া হয়নি। সেই রাত ১০টার দিকে ওর আম্মা দুধের গ্লাসটি রেখে গেছেন। বলেও ছিলেন একটু ঠান্ডা হলেই দুধটুকু খেয়ে নিও। বলেই মাথায় আদরের হাত বুলিয়ে গেলেন। মায়ের এ আদর ভীষণ ভালো লাগে ফারজাদের। মাথায় হাত পড়লেই সারা শরীরে ভালোলাগার একটা আবহ ছড়িয়ে পড়ে। মায়ের হাত ভালোবাসার এক শীতল ঝর্ণা। যা বয়ে যায় ফারজাদের গোটা দেহে। এভাবে হাত বুলিয়ে খানিকক্ষণ পাশে বসেন মা। কিছুক্ষণের খোশগল্পে মেতে ওঠে দু’জন। এর মধ্যে আসেন ফারজাদের বাবা। তিনিও মাথায় পিঠে হাত বুলিয়ে খবর নেন লেখাপড়ার। ফারজাদ বরাবরই মেধাবী ছাত্র। ক্লাসে তার অবস্থান প্রথম তিনের মধ্যেই থাকে। অষ্টম শ্রেণীতে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পাওয়ার পর স্কুলেও বেড়ে যায় ওর গুরুত্ব। শিক্ষক থেকে ছাত্র সবাই এক নামে চেনে ওকে। এর অবশ্য আরো একটি কারণ আছে। ভালো গান করে ফারজাদ। একই সাথে কবিতা আবৃত্তিও চমৎকার। বাবা-মার কাছেও এসব গুণের কারণে পেয়ে থাকে অতিরিক্ত আদর যতœ। মা তো চোখে চোখেই রাখেন। সময় পেলে কম যান না বাবাও। এভাবে আত্মবিশ্বাসী হয়ে বেড়ে ওঠে ফারজাদ। বেড়ে ওঠে অন্যরকম স্বপ্ন নিয়ে।
দুধের গ্লাসের দিকে তাকিয়ে ভাবে ফারজাদ নিশ্চয়ই আম্মুর বকা শুনতে হবে। কিন্তু ঠান্ডা দুধ খাওয়া ভালো নয় এ কথা তার আম্মু বহুবার বলেছেন। সুতরাং ঠান্ডা দুধ খাওয়া চলবে না। একটাই পথ আছে ইলেকট্রিক হিটারে গরম করে নেয়া। নাহ্। মন চাইছে না। মায়ের বকা খাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েই শুয়ে পড়লো। সুইচ অফ করতেই জমাট অন্ধকার জেগে উঠলো ঘরের ভেতর। ঘুমের দোয়াটা পড়ে নিলো সে। সেই সাথে আয়াতুল কুরসি পড়ে ফুঁ দিলো বুকে। দাদুই ওকে ঘুমের দোয়া এবং আয়াতুল কুরসি শিখিয়েছেন। কিভাবে শুতে হবে তার পদ্ধতিও দাদুর কাছে শেখা। ডান দিকে কাত হয়ে ডান হাত ডান গালের নিচে দিয়ে শুতে হয়। দাদুর এ শিক্ষা বেশ ভালোভাবেই মান্য করে ফারজাদ। আজ হঠাৎ শুতে গিয়ে দাদুর কথা মনে পড়ে গেলো। বছর দুয়েক আগে দাদু চলে গেলেন পৃথিবী ছেড়ে। দাদুর সাথেই ঘুমাতো ও। কত গল্প কত কাহিনী শোনাতেন দাদু। দাদুর জন্য মনটা খারাপ হয়ে গেলো। অনেক স্মৃতি মনে পড়ছে। অনেক কথা। ওর জন্য অভিযোগহীন ভালোবাসা ছিলো দাদুর। একটি কথা দাদু বারবার বলতেন ওকে। বলতেনÑ বড় হয়ে মানুষকে ভালোবাসবে। কারো প্রতি বিদ্বেষ রেখো না। এর সঠিক অর্থ বোঝেনি ফারজাদ। দাদু প্রায়ই বলতেন কথাটি। বড় হলে হয়তো বুঝবে এই ভেবে চুপ করে থাকতো সে। দাদুর কথা ভাবতে ভাবতে চলে গেলো ঘুমের দেশে।
কতক্ষণ ঘুমিয়েছে সে জানে না। ঘুমের ঘোরেই হঠাৎ মনে হলো ওর শরীরটা ভীষণ ভারী। নড়াচড়া করা যাচ্ছে না। ডানে বাঁয়ে ফেরার চেষ্টাও ব্যর্থ হলো। এখন সে আধো ঘুম আধো জাগরণে। তার মনে হচ্ছে বুকের ওপর কেউ চেপে আছে। মনে সারা শরীরে এক ধরনের জোর খাটিয়ে স্থির করে রেখেছে। অনেকটা অবশ হওয়ার মতো। চোখ খোলা যাচ্ছে না। চিৎকার করে বাবা মাকে ডাকবে তাও সম্ভব হচ্ছে না। চিৎকার দিয়ে গলা ফেটে যাবার জোগাড়। অথচ কোনো শব্দ বের হচ্ছে না। ওর মনে হচ্ছে কোনোভাবে কাত হওয়া গেলেই ঠিক হয়ে যেতো। কিন্তু কাত হওয়ার শক্তি যে ওর হচ্ছে না। কিছুক্ষণ সময় এভাবেই কেটে গেলো। হঠাৎ তার কানে বেজে উঠলো সেই ফিসফিস শব্দ। শব্দ হওয়ার সাথে সাথে তার শরীরটা কেউ যেনো ছুড়ে দিলো।
চোখ থেকে উধাও হয়ে গেলো ঘুমও। কিন্তু ভয়ে শরীরের সমস্ত পশম কাঁটা হয়ে গেলো। নড়াচড়া করার সাহসও যেনো নেই। যেনো জগতের সবচে ভিতু ছেলেটি ও। তবুও তাকে সাহস সঞ্চয় করতে হবে। তাকে আলো জ্বালতেই হবে। আলো জ্বললেই তো পালিয়ে যাবে ভয়। সাহস করে হাত বাড়ালো সুইচের দিকে। কিন্তু হাতটা মনে হয় বেঁটে হয়ে গেছে। সুইচ নাগাল পাচ্ছে না সে। শরীর কিছুটা এগিয়ে সুইচটি চাপলো। কিন্তু লাইট জ্বললো না। তাহলে কি সুইচ ঠিক মত চাপা হয়নি? আবার হাত চাপলো সুইচে। হ্যাঁ সুইচতো ঠিকই চেপেছে আঙুল। তবে কি লাইট নষ্ট হয়ে গেলো? সারা শরীর ঘামে ভেজা। এতক্ষণ খেয়ালই করেনি এত ঘাম জমে উঠেছে গায়ে। ফ্যানের দিকে তাকিয়ে দেখে অন্ধকারের গা ভাসিয়ে স্থির হয়ে আছে যন্ত্রটি। বিদ্যুৎ নেই কখন থেকে কে জানে। এত গভীর রাতে লোডশেডিং মনটা বিষিয়ে ওঠে ফারজাদের। লোডশেডিং কেন হবে ওর বুঝে আসে না। রাতে বিরাতে সকাল দুপুর যখন ইচ্ছা লোডশেডিং। এটা হতে পারে কি? কপালের ঘাম মুছে অসহায়ের মতো বসে থাকে ও। ঘরে বাইরে চারিদিকে কেবল অন্ধকার আর অন্ধকার। এত অন্ধকার কার ভালো লাগে। ভয়টা ধীরে ধীরে সহনীয় হয়ে উঠছে। ফারজাদ জানে ও সাহসী ছেলে। সহজে হার মানার পাত্র ও নয়। তবুও আজ ভয় ওকে এক রকম কাবু করে ফেললো। প্রায় চার বছর ধরে ও একাই ঘুমায়। ছোট ভাইটি বাবা-মার সাথে ঘুমায়। বছর চারেক আগে এক সাথেই ঘুমাতো ও। লেখাপড়ার চাপ বাড়ার সাথে সাথে ওর রুমও আলাদা হয়ে যায়। এত বছর একা থাকার অভিজ্ঞতা আজ অন্যরকম দাঁড়ালো। জিন- ভূতের ভয় ওকে কখনো কাবু করতে পারেনি। এর পেছনে ওর আম্মুর ভূমিকা কাজ করেছে। যখন ফারজাদ ভূতের প্রসঙ্গ টেনেছে তখনই ওর আম্মু বলেছেন ভূত বলে কিছু নেই। তাহলে নাটকে ভূত দেখায় কেন? প্রশ্ন করতো ফারজাদ। ওর আম্মু তখনই জবাব দিতেন ওসব বানানো ভূত! বানানো ভূত টুত কখনো ভয় পেয়ো না। সত্যিই ফারজাদ ভয় পেতো না। কিন্তু আজ এই গভীর রাতে তার কেবলই মনে হচ্ছে আম্মু বোঝানোর জন্যই তাকে বলেছে। আসলে ভূত আছে! না হলে ওকে ঘুমের ভেতর এভাবে চেপে ধরবে কে!
ধপ করে পাশে একটি শব্দ হলো তখনই। সাথে সাথে পশমগুলো আবার কাঁটার মতো দাঁড়িয়ে গেলো। আবার ভয় ঘিরে ধরলো ওকে। শব্দের দিকে ঘাড় ফেরানোর সাহসও বুঝি নেই ওর। চিৎকার দিয়ে বাবা-মাকে ডাকবে কি না বুঝতে পারছে না।
বুঝতে না বুঝতেই দৃষ্টি গেলো মেঝের ওপর। দেখে মেঝের অন্ধকারে জ্বলজ্বল করছে দুটি চোখ। কি ভয়ঙ্কর দুটি চোখের আলো। তার দিকেই যেনো চেয়ে আছে চোখ দুটি। নড়াচড়ার শক্তিও যেনো উড়ে গেছে। চিৎকার দেয়ার সাহসও নিঃশেষ প্রায়। দম বন্ধ হয়ে যাবার উপক্রম। শরীরের সব শক্তি জোগাড় করে আম্মু বলে চিৎকার দিলো। হুড়মুড় করে ছুটে এলেন বাবা-মা। ঠিক তখনই জ্বলে উঠলো লাইট। আতঙ্কে চোখ বড় হয়ে গেছে ফারজাদের। বুকে জড়িয়ে ধরলেন মা। থরথর করে কাঁপছে ফারজাদ। কোনো কথা বলতে পারছে না ও। বাবা-মার প্রশ্ন কী হলো? কী হলো?
দুই.
স্কুলে আজ বার্ষিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। ছাত্রছাত্রীরা যে যার প্রতিভা অনুযায়ী গান, কবিতা আবৃত্তি, অভিনয়, গল্প বলা ও কৌতুকে অংশগ্রহণ করছে। ফারজাদ গান এবং কবিতা আবৃত্তি করবে। অনুষ্ঠানসূচিতে এটি নির্ধারিত। স্কুলসেরা গায়ক এবং আবৃত্তিশিল্পী ফারজাদ। অনুষ্ঠানে সবার আকর্ষণ ও। ছাত্র-শিক্ষক সবার বিশ্বাস যে যাই করুক ফারজাদের একক পরিবেশনা চমৎকার হবে। গেলো বছর অনুষ্ঠান একাই মাতিয়েছে ফারজাদ। বিশেষ করে ওর গানে মুগ্ধ হয়েছে সকলেই। সবার আশা এবারও তাই হবে। ফলে ফারজাদের জন্য সবার অপেক্ষা। অথচ ফারজাদ আসেনি এখনো। অনুষ্ঠান শুরু হবার কথা সকাল ১০টায়। সাড়ে ১০টা বাজতে চললো ফারজাদের দেখা নেই। চিন্তিত ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক শিক্ষক। ওর নামে স্কুলে দেয়া মোবাইলে বেশ কবার ফোন করা হয়েছে। কেউ রিসিভ করছে না। খানিকটা ভাঙা মন নিয়ে অনুষ্ঠান শুরু করলেন সাংস্কৃতিক শিক্ষক। পবিত্র কুরআন থেকে তেলাওয়াত শুরুতেই। ফারজাদের বন্ধু ইশরাক দারুণ তেলাওয়াত করছে। তেলাওয়াতের শব্দ ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই হলরুমে। ইশরাকের তেলাওয়াতে সব সময় একটি অন্যরকম আবহ সৃষ্টি হয়। এমন আবহের ভেতর মায়ের সাথে হলরুমে ঢুকলো ফারজাদ। যেহেতু কুরআন পাঠের সময় কথা বলার নিয়ম নেই তাই কোনো শব্দ করলো না কেউ। তবে হলভর্তি ছাত্রছাত্রী ও শিক্ষকদের চোখগুলো একসাথে যেনো হুমড়ি খেয়ে পড়লো ফারজাদের ওপর। সৃষ্টি হলো নীরব চাঞ্চল্য। সবার চোখে মুখে এক ধরনের আনন্দ ঠিকরে পড়ছে। শুধু আনন্দের জ্যোতি নেই ফারজাদের মুখে। এক ধরনের ঘোরের ভেতর যেনো ডুবে আছে ও। চোখ মুখ ফোলা ফোলা। দৃষ্টি খানিকটা উদাস। চেহারায় অঘুমো উসখুস ভাব জেগে আছে।
তেলাওয়াত শেষ হতেই সাংস্কৃতিক শিক্ষক দাঁড়ালেন মাইকের সামনে। ঘোষণা দিলেন আমাদের প্রিয় ছাত্র ফারজাদ এসে গেছে। ঘোষণার সাথে সাথে মুহুর্মুহু করতালি। গোটা হল জেগে উঠলো অন্য আনন্দে। টেবিল চাপড়াচ্ছে ছাত্রছাত্রীরা। অথচ ফারজাদ তখনো প্রায় নীরব।
ছাত্রছাত্রীদের যার যা পরিবেশনা শেষ হলো। শেষ হলো শিক্ষকদের বক্তব্য-ভাষণ। শেষ হলো পুরস্কার বিতরণও। এবার একক পরিবেশনা ফারজাদের। ঘোষণা হলো ফারজাদের নাম। ধীরে ধীরে মঞ্চে উঠলো ফারজাদ। করতালিতে আবার ভরে গেলো হলঘর। আনন্দে চোখে পানি এসে গেলো ফারজাদের আম্মুর। নিজেকে ধন্য মনে হলো তার। আনন্দাশ্রু নিয়ে চেয়ে আছেন আপন সন্তানের দিকে। এই মুহূর্তে তার মনে হচ্ছে ফারজাদ এক অন্যমাপের ছেলে। তার চিরচেনা দুষ্টু ছেলেটি এটা নয়। মুখে খাবার তুলে খাইয়ে দেন যে ছেলেকে এ কি সেই! নিজের কাছেই অবিশ্বাস্য মনে হয়।
ফারজাদের কণ্ঠ বেজে উঠলোÑ তোরা দেখে যা/ আমিনা/মায়ের কোলে/ মধু পূর্ণিমারই সেথা/ চাঁদ দোলে…। প্রধান শিক্ষক আহমদ ফয়েজ এর প্রিয় গান এটি। তার আগ্রহেই শুরুতে নজরুলের গানটি গাইলো ফারজাদ। সাউন্ড সিস্টেমে ফারজাদের কণ্ঠ ভেসে ওঠার সাথে সাথে নীরব হয়ে গেলো প্রায় হাজারখানিক মুখ। গোটা হলরুমে পিনপতন নীরবতা। সুরের মোহনীয় আবহ ছাড়া আর কোনো আবহও নেই। হলভর্তি সব ক’টি চোখ ঘিরে রেখেছে ওকে। হৃদয় ঢেলে গানটি গাইলো ও। গান শেষ হওয়ার সাথে সাথে বৃষ্টির মতো করতালিতে মুখর হলো সময়। এর মধ্যে দ্বিতীয় গানটি শুরু করলো ফারজাদ। কতদিন দেহি না মায়ের মুখ/ হুনি না সে কোকিল নামের/ কালা পাহির গান…। আবার নীরবতা নেমে এলো হলঘরে। শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই হলে। হৃদয় ঢেলে গাইছে ফারজাদ। অশ্রুতে ভিজে উঠলো অনেকের চোখ। টিচারদের অনেকে পকেট থেকে রুমাল নিয়ে চোখ মোছামুছি করছেন। কেঁদে ফেললেন ফারজাদের আম্মাও। দেখাদেখি কাঁদলো ছাত্র-ছাত্রীদের অনেকেই। গান শেষ হলে মুহুর্মুহু করতালির বৃষ্টি ঝরলো অনেকক্ষণ। একটু দম নিলো ফারজাদ। তারপর শুরু করলো দেশের গানÑ একি অপরূপ/ রূপে মা/ তোমায়/ হেরিনু/ পল্লী জননী। নজরুলের এ গানটিও যেনো সবার কানে মধু ঢেলে দিলো। অনেকে অবাক। অনেকে বিস্মিত। অনেকের জিজ্ঞাসা এত কম বয়সে এত উন্নতি কি করে হলো ফারজাদের। ওস্তাদের শিক্ষা গ্রহণ করে এ কথা অবশ্যই সবাই জানে। তবুও বিস্ময়। ওর একটা নিজস্ব গায়কী ঢঙ সবাইকে অন্যরকম মুগ্ধ করে। দেশের গানটি শেষ হওয়ার সাথে সাথে আবার করতালি। করতালির ভেতর দিয়ে একজন অভিভাবক উঠে এলেন মঞ্চে। তিনি একজন বিশিষ্ট ব্যবসায়ী। স্কুল কমিটির প্রেসিডেন্ট। তার এক ছেলে এক মেয়ে এ স্কুলেরই ছাত্র-ছাত্রী। ছেলেটি ফারজাদের সাথেই পড়ে। ধীরে এসে মঞ্চে দাঁড়ালেন। ফারজাদ সালাম দিলো। একটু সরে দাঁড়ালো সে। সরতেই ফারজাদকে টেনে নিলেন পাশে। মাইক্রোফোনটি ফারজাদের হাত থেকে নিজের হাতে নিলেন। মুখ খুললেন তিন। বললেনÑ ফারজাদ আমাদের গৌরব। এ স্কুলের গৌরব। আমার বিশ্বাস ও আমাদের দেশের গৌরব হবে একদিন। আমাদের দেশকে বিশ্বের দরবারে সম্মনিত করবে একদিন। আমি সত্যিই আপ্লুত। আনন্দিত। ফারজাদ আমাদের স্কুলকে সম্মানিত করেছে। আরো করবে। গেলো বছর জাতীয়ভাবে সঙ্গীতে প্রথম স্থান অধিকার করলো। পুরস্কার দিলেন প্রধানমন্ত্রী। তখন উচ্চারিত হলো ফারজাদের নাম। সেই সাথে আমাদের স্কুলের নাম। আহা কি আনন্দই না পেয়েছি সেদিন। আমার বুকটা ভরে উঠলোÑ ওর সাফল্যে। ধন্য ওর বাবা-মা। ধন্য আমরা সকলেই। আমি ওর জন্য দশ হাজার টাকা পুরস্কার ঘোষণা করছি। সাথে সাথে শুরু হলো তুমুল করতালি। কালচারাল টিচার এসে পাঁজা কোলা করে কোলে তুলে নিলেন ফারজাদকে। ছাত্রছাত্রী, শিক্ষক-অভিভাবক সকলেই তখন দাঁড়িয়ে। সকলেই আনন্দে উদ্ভাসিত। মুখে শুভেচ্ছাশব্দ। হাতে তালি। ফারজাদের আম্মুর চোখে অনবরত আনন্দাশ্রু। বারবার মুছে নিচ্ছেন রুমালে। এমন আনন্দ জীবনে আসবে ভাবেননি কখনো। যে যার জায়গায় বসলো আগের মতো। আরো দুই চারটি গান হবে ফারজাদের কণ্ঠে।
দর্শকসারির সামনের বেঞ্চ থেকে একটি ছোট্ট শিশু দাঁড়ালো। বললো- ফারজাদ ভাইয়া। সকলের চোখ এখন শিশুটির দিকে। একটু দম নিয়ে বললো- আমার দেশের মাটির গন্ধে গানটি গাইবে?
ইয়েস ইয়েস বলে করতালি দিলো অনেকে। কোনো কথা না বলে গানটি গাইতে শুরু করলো ফারজাদ। পিনপতন নীরবতা নেমে এলো আবার। আবার কেবল শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ। আলো ঝলমল মঞ্চ। দর্শকসারির কোথাও জ্বলছে না লাইট। দিনের বেলা হলেও হলের ভেতর খানিকটা অন্ধকার জমে আছে। মঞ্চের আলোয় অন্ধকারটা আরো কিছুটা ঘন হয়ে উঠেছে। এমন আলো আঁধারির খেলার মধ্যেই বসে আছেন হাজারখানেক দর্শক। তাদের তুমুল করতালিতে যেনো টলে ওঠে হালকা অন্ধকার। গানটি গেয়ে যাচ্ছে ফারজাদ। গানটি শেষ করার ঠিক আগ মুহূর্তে হঠাৎ চলে গেলো বিদ্যুৎ। থেমে গেলো গানও। হঠাৎ আলো চলে গেলে চোখে একরকম ধাঁধা লেগে যায়। সে ধাঁধা অন্ধকারের। মঞ্চে ফারজাদ একা। হঠাৎ সাউন্ড থেমে গেলো। ওর গানও থেমে গেলো। চোখ ঘুরিয়ে নিলো দর্শকসারির দিকে। আনমনে চোখ গেলো হলরুমের ছাদে। হঠাৎ ওর চোখ আটকে গেলো ছাদের মাঝ বরাবর। অন্ধকারে জ্বলছে সেই দুটি চোখ। গতকাল মধ্যরাতে যা জ্বলেছিলো ওর ঘরের মেঝে। জ্বলন্ত চোখ দুটি যেনো ভয়ের সেল ঢুকিয়ে দিলো ওর বুকে। মুহূর্ত খানিক। তারপরই সেন্স হারিয়ে ফেললো। পড়ে গেলো মঞ্চে।
তিন.
হাসপাতালের বেডে শুয়ে ফারজাদ। পাশেই ওর মা- বাবা। কালচারাল টিচার এবং একজন লোক ফারজাদের বাবার বয়সী। সম্ভবত ওর বাবার বন্ধু।
চোখ খুলতেই ফারজাদ দেখলো মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন ওর মা। মায়ের চোখ অশ্রুসিক্ত। লাল এবং খানিকটা ফোলা। ভাবে ফারজাদ- না জানি কতটা কেঁদেছেন মা।
সবার জিজ্ঞাসা- কি হয়েছিলো ফারজাদের? কেন ও সেন্সলেস হলো? এখন কেমন বোধ করছে ইত্যাদি নানা প্রশ্নের মুখে ও। কোনো প্রশ্নের জবাব নেই ওর মুখে। এক ধরনের ঘোর এবং উদাস দৃষ্টি মেলে চেয়ে আছে ও। মনে হয় কোনো প্রশ্নের জবাব ওর জানা নেই। অথবা জবাব দেবার প্রয়োজনও নেই। দৃষ্টিতে এমন ঘোর জাগিয়ে শুয়ে আছে সে। কপালে হাত রেখে বারবার একই প্রশ্ন জিজ্ঞেস করছে ওকে।
ডাক্তার ঢুকলেন রুমে। জায়গা ছেড়ে দিয়ে দাঁড়ালেন ফারজাদের মা। বললেন- ডাক্তার সাহেব কী হয়েছে আমার সোনা মানিকের! কেন এমন হলো! দয়া করে দেখুন।
ডাক্তার বললেন- চিন্তা করবে না। দেখি কী হয়েছে! পাল্স দেখলেন ডাক্তার। চোখ উল্টিয়ে চোখের ভেতরটা দেখলেন। দেখলেন জিহবার রঙ। তারপর শ্বাস-প্রশ্বাসের গতি পরীক্ষা করলেন। পেট পিঠ দেখলেন। বললেন-ওর শারীরিক সমস্যা আছে বলে তো মনে হচ্ছে না। আগে কখনো এমন তো আর হয়নি ডাক্তার সাহেব জবাব দিলেন ফারজাদের আম্মু। বললেন- আমার ছেলেটার তেমন কোনো রোগ শোকতো নেই। ছিলো না। ওরতো সহসা জ্বর সর্দিও হতো না। কবে ও ডাক্তারের কাছে গেছে আমাদের মনে নেই। কেন এমন হলো আমার সোনার ছেলেটির!
হ্যাঁ ডাক্তার সাহেব ওকে নিয়ে আমরা বেশ চিন্তামুক্ত ছিলাম। ছোট থেকেই ওর অসুস্থতা কম। ওর ছোট ভাইটি এখনো অনেক ছোট ওরও আল্লাহর রহমতে তেমন অসুস্থতা নেই। কথাগুলো বলে দম নিলেন ফারজাদের বাবা।
ডাক্তার তখনো ফারজাদের নানা জায়গা দেখছে। চেপে চুপে কোনো ক্লু আবিষ্কার করা যায় কি না খুঁজছেন। কিন্তু না ডাক্তারের বরাবরই এক কথা- ওর শারীরিক কোনো সমস্যা নেই। তবে নার্ভাসনেস কাজ করতে পারে কোনো কারণে। তার জন্য আমাদের আরো একটু পর্যবেক্ষণ দরকার। আমরা আরেকটু সময় নিতে চাই। বরং ওকে বাসায় নিয়ে যান। আবার কখনো এমন হয় কিনা দেখুন। হলেই সাথে সাথে নিয়ে আসবেন। তখন কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা যাবে।
ডাক্তার ইমরুল চৌধুরীর ওপর অগাধ আস্থা ফারজাদের বাবার। মেডিসিন বিশেষজ্ঞ এই ডাক্তার বেশ নির্ভরযোগ্য। যেমন সেবার মানসিকতা তেমনি আন্তরিক। তেমনি অভিজ্ঞ। রোগীর চোখ আর জিহ্বা দেখে নাড়িভুঁড়ির খবর বলে দেয়ার মতো ডাক্তার আমাদের দেশে কমই আছে। ডাক্তার চৌধুরী তেমনি একজন। তিনি প্যাথলজি অস্বীকার করেন না। কিন্তু কথায় কথায় প্যাথলজিতে শরণাপন্ন হওয়ার ঘোর বিরোধী।
ডাক্তারের কথায় হাসপাতাল থেকে সোজা বাসায়। বাবা-মা দু’জনই লক্ষ্য করলেন ফারজাদের উদাসী ভাব। কি এক ঘোরের ভেতর হাবুডুবু খাচ্ছে ও। অথচ মন খুলে বলছে না কিছুই। মহা চিন্তায় পড়ে গেলেন ফারজাদের মা। মনের এ ভাবনার কথা প্রকাশও করছেন না। মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলেন- ফারজাদকে আর একা চলতে দেবেন না তিনি। তার যত ক্ষতি কিংবা সমস্যা হোক ফারজাদের সঙ্গেই থাকবেন তিনি।
পাশের মসজিদ থেকে ভেসে আসছে মাগরিবের আজান। সন্ধ্যার এ মুহূর্তটি অন্য রকম মনে ফারজাদের। দিনের আলো শেষ হয়ে যায়। পুব দিক থেকে নেমে আসে অন্ধকার। ধীরে ধীরে অন্ধকার গাঢ় হয়। আর আকাশে ফুটে ওঠে অসংখ্য তারা। ফারজাদদের বাসার সামনে ছোট একটি বাগান। বাগানে আম, জাম, চালতা, কাঁঠালসহ বেশ কিছু গাছ জড়াজড়ি করে আছে। সন্ধ্যার সময় কিছু পাখি এসে ভিড় করে এখানে। খুব ভালো লাগে ফারজাদের। তিন তলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে এসব পাখির কলকাকলি শোনে। দেখে বাগানের ভেতর কি ভাবে জমে ওঠে অন্ধকার। শীতকালে কুয়াশা জমাট বাঁধে বাগানে। আর রাতের বেলায় দলছুট কিছু জোনাকি জ্বলতে থাকে রাতভর। এসবে দারুণ আনন্দ পায় ফারজাদ। আজ বারান্দায় দাঁড়িয়েই আজান শুনলো ও। মাগরিবের আজানেও যেনো একধরনের বেলা শেষের টান আছে। যেনো রাতকে আহ্বান করে ধ্বনিত হচ্ছে আজান। ফারজাদের এ ভাবুক মনটাকে ওর বন্ধুরা তিরস্কার করে। বলে ওতো বড় হয়ে কবিই হবে। ও কবিদের মতো ধ্যানমগ্ন থাকে। মুচকি মুচকি হাসে ফারজাদ। বলে তোদের কথাই যেনো সত্যি হয়রে। কবি হওয়াতো ভাগ্যের ব্যাপার। জবাব শুনে চুপসে যায় বন্ধুরা। কেউ কেউ আবার তাল মেলায়- ঠিকই বলছিসরে বন্ধু। কবি হওয়া ভাগ্যেরই ব্যাপার বটে। কারণ ইচ্ছে করে তো আর কবি হওয়া যায় না।
বাগানের একটি চালতা গাছ বেশ বড় হয়ে উঠেছে। তিন তলা ছাড়িয়ে গেছে এর মধ্যে। ফারজাদের বারান্দা থেকে হাত বাড়িয়ে অনায়াসে চালতা পাতা ধরা যায়। ধরা যায় চিকন চাকন কিছু ডালও। বারান্দায় দাঁড়ালেই চালতা পাতা ধরার লোভ সামলাতে পারে না ফারজাদ। কী দারুণ কাজ করা পাতাগুলো। পাতার শরীরে যেনো শৈল্পিক নকশা আঁকা। পাতার এ নকশা বেশ লাগে ফারজাদের। বরাবর ফারজাদ বৃক্ষপ্রেমিক। একেবারে ছোট থেকেই বৃক্ষের প্রতি এক ধরনের ভালোবাসা কাজ করে ওর ভেতর।
একটি চালতা পাতা ধরে আলতো করে টান দিলো ফারজাদ। টান খেয়ে একটি ছোট ডাল এসে লাগলো বারান্দার গ্রিলে। নাড়া খেয়ে একটি পাখি ফুড়–ৎ করে উড়ে গেলো অন্য ডালে। এ চালতা গাছটায় অনেক পাখির বাসা থাকে। শালিক, ফিঙে এমনকি কাকও বাসা বাঁধে এখানে। কাকের বাসা প্রায় নিয়মিতই থাকে। সন্ধ্যার সাথে সাথে হুতুম পেঁচার দেখা মেলে গাছটায়। লাফালাফি করে কাঠবিড়ালি। বড় বড় লাল পিঁপড়ার বাসা গাছটাকে যেনো ভারী করে তুলেছে। এসব খুঁটিনাটি বিষয় দেখে ফারজাদ। দেখে দারুণ আনন্দ পায়।
পাতাটি টেনে পাতার গায়ে হাত বোলায় ফারজাদ। পাতার সবুজ আনন্দ যেনো ওর মনকে স্পর্শ করে। সন্ধ্যার ঝিরি বাতাসে বড় বড় পাতাগুলো কাঁপছে ধীরে। সে বাতাস তাকেও বুলিয়ে যায়। তার গায়েও জাগে শীতল আবহ। মনে পড়ে একবার কোত্থেকে একটি বানর এসে পড়েছিলো গাছটায়। সেকি লাফালাফি বানরটির। কেন কিভাবে বানরটি এখানে এসে পড়েছিলো জানে না কেউ। এক বিকেল আর এক রাত ছিলো। তারপর কোথায় উধাও হয়ে গেলো তাও কেউ জানলো না। বানরটিকে ঘিরে সেকি ছেলেমেয়েদের উল্লাস। জমায়েত দেখে বানরটিও লাফালাফি করলো দ্বিগুণ। এসব ভাবছে আর পাতার গায়ে হাত বোলাচ্ছে। সাধারণত অন্ধকার নেমে আসা পর্যন্ত বারান্দায় থাকে না ও। আজ কি যে ভালো লাগছে। বারান্দা ছেড়ে যেতেই ইচ্ছে করছে না। এর মধ্যে দু’দুবার ওর আম্মু ডেকে বলেছেন- নামাজ পড়ে পড়তে বস।
আসছি আম্মু বলে আবার মগ্ন হয়। এভাবে প্রায় অন্ধকার জমাট বেঁধে গেছে। বাগানে অন্ধকার আরো ঘন হয়ে উঠেছে। একটি বাদুড় ঝুপ করে বসলো একটি ডালে। বাদুড়টা বেশ বড় সড়। ভীষণ কালো। গা চমকে গেলো ফারজাদের। ডালটি ধরে ঝুলছে বাদুড়টি। মুঠো ছাতা গুছিয়ে রাখলে যেমন তেমনটিই মনে হচ্ছে বাদুড়টিকে। বাদুড়ের এ নীরব খেলা দেখছে ফারজাদ। দেখতে দেখতে চোখ পড়লো মোটা ডালটার সংযোগস্থলে। চোখ পড়তেই একটা প্রচন্ড ঝাঁকুনি খেলো। ভয়ে কেঁপে উঠলো সারা শরীর। আলোর লাল শিখা যেনো ওকে গেঁথে দিচ্ছে। আউ শব্দ করে দ্রুত ঢুকে পড়লো ভেতরে। শরীরের সমস্ত পশম খাড়া হয়ে আছে। ধড়ফড় করছে বুক। কাঁপতে কাঁপতে কোনোরকম খাটে এসে শুয়ে পড়লো ও। চোখ বন্ধ করলেই দেখে সেই চোখ দুটি। যেনো ওকে পোড়াবে!
চার.
কপালে হাত রাখলেন ফারজাদের আম্মু। বললেন- তুমি কাঁপছ কেন বাবা? তোমার কি শরীর খারাপ? কি হয়েছে আম্মুকে বলো। চোখে মুখে চিন্তার ছাপ। এক ধরনের ভয় ফারজাদের আম্মুর কণ্ঠে ভেসে উঠছে।
কোনো কথা বলে না ফারজাদ। এক ধরনের কুঁজো ভঙ্গিতে চুপটি করে শুয়ে আছে। আর কাঁপাকাঁপি করছে। তার চোখে তখন রাজ্যের ভয়। চোখ খুললেই বুঝতে পারতো ওর মা। কিন্তু চোখ বন্ধ। তবুও ভয়ে চেহারা খানিকটা ফ্যাকাসে হয়ে উঠেছে।
অস্থির হয়ে উঠলেন ফারজাদের মা। অজানা আশঙ্কায় তিনিও ভয়ে কাতর। ভাবছেন আবার মূর্ছা যায় কি না! কি সমস্যা হলো ছেলেটির এত সুস্থ সুন্দর একটা ছেলে। ওর কোনো অসুখ বিসুখ ছিলো না। হয়নি। হয় না। এখন কিসে কি হয়ে গেলো। কেন হলো। ডাক্তার বললেন কিছুই হয়নি। নাকি আসল কারণ ধরতে পারেননি ডাক্তার। কে জানে। অন্য কোনো ডাক্তার দেখাবেন কিনা? দেখালে কোন ডাক্তার দেখানো যায়। ইত্যাকার নানান জিজ্ঞাসা নানান চিন্তায় মনটা অস্থির হয়ে উঠলো।
ফারজাদ নির্বিকার। ওর কাঁপুনি কিছুটা থেমেছে। কিন্তু চেহারায় ভয়ের চিহ্ন আগের মতই। আগের মতই ও কুঁজো দিয়ে কাত হয়ে আছে। মাঝে মাঝে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। তখন মনে হয় ও কোনো ভয়ানক কষ্টের সময় পার করছে। কিন্তু ওর মুখে কোনো কথা নেই। কিছুই বলছে না। ওর ধারণা ঘটনাটা বললেই সবাই ভাববে ওকে ভূতে পেয়েছে। তখন কি হবে। ও তো ভূত প্রেতে বিশ্বাস করে না। ওর দাদুই ওকে বলেছেন ভূত বলে কোনো কিছু জগতে নেই। সুতরাং ভূতকে ভয় পাবারও কিছু নেই। ওর দাদু বরাবরই ওকে এই কথাগুলো বলতেন। বলতেন এসব এক ধরনের কুসংস্কার। মানুষ অজ্ঞতা থেকেই এসব বলে বেড়ায়। অথবা কেউ কেউ সুবিধা আদায়ের জন্য এসব ভূতের কাহিনী সাজায়। তাহলে ওর বেলায় এটা কি ঘটছে? কেন ঘটছে? ঘটনাটা কি বলবে নাকি বলবে না? এই নিয়ে নিজেই নিজের সাথে লড়াই করে। ভেতরে ভেতরে সাহসটা দৃঢ় করে। না ও কাউকেই এ ঘটনা বলবে না! দেখা যাক কি হয়! কতদূর যায় এ কাহিনী। কত বীরদের কাহিনী ও জানে। শুনেছে ওর দাদুর কাছে। ও কেন সামান্য এ ঘটনায় এতটা কাতর হবে। কেন ভয়ে পড়ে থাকবে বিছানায়। গা ঝাড়া দিয়ে উঠলো ও। চেহারা থেকে ভয়ের চিহ্ন মুছে ফেলতে চায়। দূর করতে চায় যত রকমের বাজে চিন্তা।
বিছানায় তড়াক করে উঠে বসলো ফারজাদ। বললো- মা আমার ক্ষুধা পেয়েছে। কিছু খেতে দাও। পড়তে বসবো। আজ টিচার পড়াতে আসবেন না। গতকালই তিনি বলে গেছেন। ঢাকার বাইরে যেতে হবে তাকে। ফলে আজ নিজে নিজে পড়তে হবে ফারজাদকে।
ওর আম্মুর মনটা ভীষণ খুশি হয়ে গেলো। ছেলের চঞ্চলতা ফিরে আসছে দেখে আনন্দে তিনিও চঞ্চল হয়ে উঠলেন। ছেলের সবচেয়ে পছন্দের খাবার চিকেন ফ্রাই করবেন এখন। মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন- এক্ষনি তোমার রেডি করে নিয়ে আসছি। তুমি হাত মুখ ধুয়ে নাও। বলেই চলে গেলেন রান্না ঘরে।
এক ধরনের দৃঢ়তা নিয়ে ফারজাদও খাট ছেড়ে দাঁড়ালো। পা বাড়ালো ওয়াশ রুমের দিকে। ভালো করে হাত ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে নিলো। চোখে মুখে ঠান্ডা পানির ছোঁয়া। গোটা শরীরে এক ধরনের ভালো লাগা ছড়িয়ে পড়লো। আজ অনেক রাত জেগে পড়তে হবে ওকে। ওয়াশ রুমের আয়নায় নিজেকে দেখে বারবার। দেখে চোখ চোখের ভেতরটা। না চোখের লালচে ভাব কেটে গেছে। ওর চেহারা থেকেও কেটে গেছে ভয়ের চিহ্ন। ভেতরের দৃঢ়তা চেহারায় চোখে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। নিজের চেহারা দেখে নিজেই খুশি হয়ে ফারজাদ। হাত মুখ মুছে পড়ার টেবিলেই বসে পড়লো ও। পানির বোতল থেকে এক চুমুক পানি খেলো। খানিকটা ঠান্ডা পানি। খেতে কি যে ভালো লাগলো। গোটা শরীরে সে ভালো লাগার অনুভূতি।
চিকেন ফ্রাই হাতে ওর আম্মু। বললেন- নাও। গরম গরম খাও। ভালো লাগবে। খেয়ে লেখাপড়া কর। যদি কোনো কারণে খারাপ লাগে আমাকে সাথে সাথে ডাকবে। মাঝে মাঝে আমিতো দেখে যাবোই। মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো ফারজাদ। মুখে চিকেন ফ্রাই এর স্বাদ। চিকেন ফ্রাই ওকে চাঙ্গা করে তুলেছে। পড়াশোনা ভালোই হবে। একেবারে মনোযোগ দিয়ে পড়বে ও।
গান আবৃত্তি ভালো করবেই। লেখাপড়াও ভালো করতে হবে। ও বরাবরই ভালো ছাত্র। সুনামটি ধরে রাখতে সাধনা করেই যাচ্ছে ও।
চিকেন ফ্রাই খেতে খেতে স্কুল রুটিনের ওপর চোখ বোলায়। কোন কোন বিষয়ে প্রস্তুতি নিতে হবে দেখছিলো এসব। ওর টিচার আসবেন না আজ। না এলেও আজ অসুবিধা নেই।
জটিল কোনো বিষয় আজ নেই। ফলে ক্লাস প্রস্তুতি নিতে অসুবিধা হবে না। ভাবতে ভাবতে চিকেন ফ্রাই এর দফা রফা করছে ও। চিকেন ফ্রাইটা ওর এত কেন মজা লাগে ও নিজেও জানে না। কত রকমের খাবারই না আছে। কোনো খাবারই এই পদার্থটির সাথে তুলনীয় হয় না। এর মধ্যে শেষ হয়ে গেলো চিকেন ফ্রাই। বোতলের মুখে পানি খেয়ে নিচ্ছে ও। যথার্থভাবে পানি ঢালে মুখে। এক ফোঁটা পানিও মুখের বাইরে পড়ে না। বোতলে পানি খাওয়াও একটি প্র্যাকটিসের বিষয়। প্রথম দিকে ও কোনোভাবেই বোতলের মুখে খেতে পারতো না। এখন অনায়াসে ঢকঢক করে গিলে খায়। পানি খাওয়া শেষ। কোন বিষয় পড়বে ভাবছিলো। ভাবতে ভাবতে চোখে পড়লো বইটি- জীবন যাপনের শিল্পকলা। লেখক আঁদ্রে মারওয়া। বইটি ওর খুব প্রিয়। আরো ছোট যখন তখনও বড়দের বইয়ের প্রতি ওর চোখ। অনেক কঠিন বইও অনায়াসে পড়ে ফেলে ও। জীবন যাপনের শিল্পকলা বইটির প্রচ্ছদ দেখছে ও। যতবার দেখে ততবারই ওর ভালো লাগে। কালারফুল প্রচ্ছদের রঙগুলো যেনো জীবনের রঙের মতো। ভাবতে ভাবতে কিছুটা আনমনা হয়ে গেলো। এ সময় কলিংবেল বাজলো দরজায়। ভাবনায় ছেদ পড়লো ওর। পাতা উল্টাচ্ছে বইয়ের। কি খবর, কি পড়ছ বলে রিডিং রুমে ঢুকলেন গৃহশিক্ষক। শিক্ষককে সালাম জানিয়ে দ্রুত দাঁড়ালো ফারজাদ। বললো- স্যার আপনি…।
হ্যাঁ আমার ঢাকার বাইরে যাওয়ার কথা ছিলো, যাইনি। তাই চলে এলাম।
জি স্যার বললো ফারজাদ।
ফারজাদকে বসার নির্দেশ দিয়ে নিজেও বসলেন চেয়ারে।
ফারজাদ বললো- স্যার আসার আগে আপনি তো ফোন দেন?
হ্যাঁ। ভাবলাম তুমিতো বাসাই আছ। যাই। চলে এলাম। কোনো অসুবিধা নেই তো?
না স্যার অসুবিধা নেই।
কি পড়বে আজ, বায়োলোজি?
আগে ইংরেজি পড়বো স্যার।
ওকে তাই পড়ো।
পড়তে শুরু করলো ফারজাদ। স্যার যেখানে প্রয়োজন বুঝিয়ে দিচ্ছেন। কিভাবে মর্মার্থ উদ্ধার করবে ধরিয়ে দিচ্ছেন তাও। স্যারের কথা বলার স্টাইল খুব সুন্দর। শুদ্ধ ভাষায় স্পষ্ট উচ্চারণে কথা বলেন তিনি। স্যারের কথা বলার ঢঙটা দারুণ পছন্দ ফারজাদের। এর মধ্যে প্রায় রপ্ত করেছে স্টাইলটি। ক্লাসে, বন্ধুদের সাথে এ স্টাইলেই কথা বলার চেষ্টা করে ও। স্যার আজ কথা বলছেন খুব কম। কণ্ঠটাও অন্যরকম শোনাচ্ছে। ঠান্ডা লেগেছে বোধয়- ভাবে ফারজাদ। জিজ্ঞাসাও করলো- স্যার আপনার কি ঠান্ডা লেগেছে? স্যার নিচের দিক থেকে চোখ তুললেন ফারজাদের দিকে। মুহূর্তে ফারজাদের ভেতরটা কেঁপে উঠলো ভয়ে! স্যারের দুটি চোখ আগুনের বলের মতো জ্বলছে। সন্ধ্যায় চালতা গাছে দেখা দুটো চোখ বসে আছে স্যারের চোখে।
সারা শরীর কাঁপছে ফারজাদের। আম্মা… বলে চিৎকার দিলো। চেয়ার থেকে ঢলে পড়লো মেঝে। স্যারের জন্য চা প্রস্তুত করছিলেন ওর আম্মা। কিচেন থেকে দৌড়ে এলেন। দেখলেন তার অচেতন ছেলেটি পড়ে আছে মেঝে। স্যার ওকে খাটে তোলার চেষ্টা করছেন।
আমার বাবার কী হয়েছে বলে একরকম লাফিয়ে এসে ধরলেন ছেলেকে। দু’জনে ধরে খাটে শোয়ালেন।
টিচার বললেন- আন্টি একটু ঠান্ডা পানি নিন।
ঠান্ডা পানির ছিটা দিচ্ছেন টিচার। একবার দুবার তিনবার। না। ওর সেন্স ফিরছে না। আবার পানির ছিটা। একবার দু’বার তিনবার। নড়ে উঠলো ও। ধীরে অতি ধীরে চোখ খুললো। বাবা কি হলো তোর। কি হলো। বল আম্মুকে বল। ফারজাদের মুখের দিকে ঝুঁকে করুণ কণ্ঠে কথা গুলো বললেন ওর মা।
ফারজাদ ভয়ে বিস্ময়ে চেয়ে আছে ওর টিচারের দিকে।
পাঁচ.
একা থাকতে দারুণ ভয় ফারজাদের। আজ আর কোনোভাবেই একা থাকার সাহস করছে না ও। কিন্তু মুখ খুলে কাউকে কিছু বলছেও না। বারটার কাঁটা পেরিয়ে গেছে রাত। লেখাপড়া করছে ফারজাদ। খাটে শুয়ে আছে ওর আম্মু। শুয়েই জিজ্ঞেস করলেন- বাবা তোমার লেখাপড়া শেষ হয়েছে?
আর একটু বাকি আছে আম্মু।
ঠিক আছে শেষ কর। আমি আছি। যতক্ষণ তোমার দরকার পড়ো।
পড়ছে ফারজাদ।
ওর আম্মুর চোখ বন্ধ। ডান হাতটা কপালের ওপর রাখা। দেখে মনে হয় ঘুমিয়ে পড়েছেন। আবার মাঝে মাঝে কথাও বলছেন।
ফারজাদ ওর আম্মার চোখের দিকে তাকাচ্ছে না। চোখের দিকে তাকাতেই ওর ভয়। এই মুহূর্তে ওর মনে হচ্ছে কারো চোখের দিকেই তাকাতে পারবে না ও।
আম্মু চোখ বন্ধ রেখেই আবার বললেন- আজ একা থেকো না। আমাদের সাথেই ঘুমাবে তুমি।
কোনো কথা বলে না ফারজাদ। দ্বিধায় পড়েছে ও। একা থেকে থেকে কারো সাথে থাকা এখন আর পছন্দ না ওর। কিন্তু ভয়টাও মনকে কাবু করে রেখেছে। ফলে সে একা না এক সাথে থাকবে তার কোনো জবাব দিচ্ছে না।
জবাব না পেয়ে চোখ খুললেন তিনি। কপাল থেকে হাত সরিয়ে এক নজর দেখে নিলেন ছেলেকে। দেখলেন ছেলেটির চোখ বইয়ের পাতায়। কিন্তু আনমনা। এক ধরনের উদাসী চোখ।
জিজ্ঞেস করলেন- বাবা তোমার কি খারাপ লাগছে? আজ না হয় আর পড়ো না। কিছুটা বাকি থাকলে থাক। চলো আমাদের সাথে ঘুমাবে। রাত অনেক হলো। তোমার বাবা অপেক্ষা করছেন তোমার জন্য।
আম্মু তুমি যাও। আমি আসছি। বলেই বইয়ের দিকে দৃষ্টি দেয়। কথা না বাড়িয়ে চলে গেলেন ওর আম্মু। বললেন- দেরি করো না। স্কুল আছে সকালে।
ভাবছে ফারজাদ। ও কি একা থাকবে?
এক মন বলছে একাই থাকো। আরেক মন ভয়ে কাতর। বলছে না না। কোনোভাবেই একা থাকা চলবে না। গভীর রাতে ওই চোখ দেখা অসম্ভব।
কিন্তু ওতো সাহসী- ভাবে ফারজাদ। সবাই জানে ওর সাহসের খবর। সবাই জানে ও ভয়ে কাতর হয় না। রাতের আঁধার দিনের আলো দুটোই ওর জন্য সমান। সুতরাং ও কেন ভয়ের কাছে পরাজিত হবে! হবে না। ওকে সাহসের সাথেই চলতে হবে। থাকতে হবে। অতএব ও একা থাকার সিদ্ধান্ত নিলো।
আম্মুকে ডেকে বললো- আমি একাই থাকবো। তোমরা ঘুমাও। আমার পড়া এখনো বাকি আছে। পড়া শেষ করে আমি শুয়ে যাবো। চিন্তা করো না।
কোনো সমস্যা হলে ডেকো আমাদের। ঠিক আছে আল্লাহ মেহেরবান।
পড়ায় মন বসছে না ওর। তবুও বইয়ের পাতায় নিবদ্ধ চোখ। মনে নানা রকম ভাবনা। আগডুম বাগডুম কত ভাবনা এসে ভিড় করছে মনে। ছোটবেলায় কেমন ভিতু ছিলো ও। কুকুর দেখে সেকি চিৎকার। বিড়াল দেখে কান্না। এমনকি মোরগ মুরগিও ছিলো ভয়ের। ধীরে ধীরে এসব ভয় দূর করেছেন ওর বাবা। আর সাহসী করে তুলেছেন ওর দাদু। দাদু কত বীরের গল্প শুনিয়েছেন। শুনিয়েছেন অনেক বিজয়ীর কাহিনী। কাদের সাথে লড়াই করে মানুষ কিভাবে জয়ী। সাঁতরিয়ে সমুদ্র পাড়ি দেবার ঘটনা। একজন যোদ্ধা শত শত শত্রুকে পরাস্ত করে কিভাবে জয়ী হয়। এসব কাহিনী শোনাতেন দাদু। শুনিয়েছেন দিগি¦জয়ী আলেকজান্ডারের গল্প। নেপোলিয়ান বোনাপার্ট এর গল্প। হজরত ওমরের বীরত্ব। হজরত আলীর বীরত্বগাথা। কত কিছু যে মনে পড়ছে ওর। দাদুর এ সমস্ত গল্প-কাহিনী ওকে সাহসী করে তুলেছে। সুতরাং সাহসী ফারজাদ একাই ঘুমাবে। ঘুমাবে ওর নিজের রুমেই। কিন্তু চেয়ারেই বসে আছে ও। রাত প্রায় ১টা। অথচ ঘুমুতে ইচ্ছে করছে না। পড়তেও না। আনমনে বসে থাকাও কি কোনো কাজ? নাহ্! বসে থাকা কাজ হয় কি করে?
কিন্তু কাজ নয় কেন সেটিও প্রশ্ন।
ওর ঘুমুতে ইচ্ছে করছে না। পড়তে ইচ্ছে করছে না। ও করবে কি? বসেই থাকবে! হ্যাঁ বসেই আছে ও। বসে আছে রাজ্যের ভাবনা নিয়ে। হাতের কাছে ডায়েরিটা। খুলে আঁকিবুঁকি করছে। যা মনে আছে তা-ই লিখছে। এটি ওর ছোটবেলা থেকে অভ্যাস। মাঝে মাঝে এই ঘটনা ঘটে। কিছু করতে ইচ্ছে না করলে ডায়েরির পাতায় ইচ্ছে মতন লেখা। যে শব্দটি যে বাক্যটি মনে আসে সেটাই লিখে যায়। এটার একটি আনন্দ আছে।
আজ এ আনন্দও ওকে স্পর্শ করছে না। তবুও ও লিখে যাচ্ছে। ও লিখছে এখন আমার কিচ্ছু ভালো লাগছে না। কিচ্ছু না। কেন ভালো লাগছে না তাও জানি না। ভয়ের কারণে? আমি কি ভয় পাচ্ছি! কই নাতো! আমি কেন ভয় পাবো। আমি তো সাহসী ছেলে। আমি ভয়কে জয় করবো এমন কথা বহুবার বলেছি দাদুকে। এখনো বলছি। হ্যাঁ দাদু আমি ভয় পাবো না। কিসের ভয়। কোথায় ভয়! কখন ভয়। আমি তাকে খুন করবো। জয় করবো জীবনকে।
আমি স্বপ্ন দেখি। বিশাল স্বপ্ন। অনেক বড় স্বপ্ন। যে স্বপ্ন সমান। যে স্বপ্ন সমুদ্র সমান। আমি অনেক বড় হবো। অনেক বড়। দেশ সেরা হতে হবে আমাকে। হ্যাঁ আমি হতে পারবো। হতেই হবে আমাকে। এই কি সব ভাবছি আমি! নাহ্ ঠিকই ভাবছি! আরো ভাবতে হবে আমাকে। এমন নানান ভাবনা আঁকিবুঁকি করার ভেতর কোন ফাঁকে ঘুমিয়ে পড়লো ও। ডায়েরির ওপর হাত। তার ওপর মাথা দিয়ে চেয়ারেই ঘুম।
কতক্ষণ ঘুমিয়েছে জানে না ও। হঠাৎ ওর ঘুম ভেঙে গেলো। মনে হলো পিঠে কোনো হিমশীতল হাতের ছোঁয়ায় ভাঙলো ঘুম। শীতল অনুভব এখন প্রায় সারা শরীরে ছড়িয়ে গেছে। নিজেকে যতই সাহসী ভাবুক মনে হচ্ছে ভয় ওকে গ্রাস করে ফেলেছে। চারদিকে বুঝি ভয়ের দেয়াল। চোখ তুলে ফিরে তাকানোর সাহসও বুঝি নেই ওর। তবুও সাহস করে ও। বসেই চোখ বুলিয়ে নিলো রুমের চারদিকে। না। কেউ নেই। কোনো কিছু নেই। ফ্যান ছাড়া আর কিছুর নড়াচড়াও নেই।
তাহলে? ওর অনুভব কি ভুল?
কিসের ভুল! এইতো এখনো পিঠে হাতের স্পর্শের অনুভূতি। এইতো অস্বাভাবিক শীতলতা। আস্ত বরফের মতো ঠান্ডা। এমনতো হয়নি কখনো!
ওর কি হলো? নিজেকে নিজেই প্রশ্ন করে।
ও নিজেও জানে না কি হলো ওর। শুধু ভয়! শুধু ভীতি! শুধু অদ্ভুত কল্পনা। নাহ্ আমাকে ভয় থেকে বের হতে হবে। আয়াতুল কুরসি পড়ে আবার ফুঁ দেয় বুকের ওপর। তখনো ধুকপুক করছে বুক। হাতুড়ির মতো পেটাচ্ছে বুকের ভেতরটা। দীর্ঘশ্বাস নেয়। ছাড়ে। আবার নেয়। আবার ছাড়ে। এভাবে বেশ কবার। মনে হচ্ছে ধুকপুকানি কমেছে কিছুটা।
আবার চেয়ারে বসলো ও। আবার ডায়েরি টেনে নেয়। নাহ্ এবার যা ইচ্ছে তাও আঁকতে ভালো লাগছে না। ও এখন ঘুমাবে। ওর খাটেই ঘুমাবে। যা হবার হোক। ভয়ের কাছে পরাজিত হবে না ও। খাটে সটান শুয়ে পড়লো। শুয়ে শুয়ে ভাবছে অনেক কিছু। মাঝে মাঝে খামখাই গায়ের পশম দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। অথচ ও তো ভয়কে পাত্তা দিচ্ছে না। অনেকক্ষণ। চোখের কোনায় কোথাও ঘুম নেই। ঘুমের আন্ডা বাচ্চাও নেই চোখে।
ওর মনে হলো লাইটের কারণে ঘুম আসছে না। কিন্তু লাইট অফ করার সাহসও নেই। সুইচের দিকে হাত বাড়িয়ে আবার গুটিয়ে নেয়। অন্ধকারে নিজেকে ডুবিয়ে দেবার মতো সাহস পাচ্ছে না। লাইট জ্বালিয়েই শুয়ে রইলো। শুয়ে থাকতে থাকতে কখন ঢলে পড়লো ঘুমের কোলে জানে না ও।
ঘুম যখন ভাঙলো দেখে ওর বাবা-মা দু’জন ওর দুই পাশে। দু’জনই বসে আছেন। দু’জনের চোখই ওর দিকে। দুদিকে ঘাড় ঘুরিয়ে দু’জনকে দেখে নিলো। বললো- তোমরা এখানে? বসে আছে যে? সকাল হয়ে গেছে? বলেই দেয়াল ঘড়িটা দেখে নিলো। না। এখন রাত ৩টা। তবে? কি হয়েছে? বিড়বিড় করছে ও।
আম্মু বললেন- কতবার বললাম আমাদের সাথে ঘুমাও। না। শুনলো না কথা। এভাবে ভয়ের ভেতর একা থাকার কি দরকার?
কি হলো আম্মু? কেন বলছো এগুলো?
কি আর হবে। চিৎকার দিয়ে ঘর ফাটিয়ে দিচ্ছিলি। এসে দেখি তোর চোখ দুটো ছাদের দিকে উল্টানো। চোখের সাদা অংশ বেরিয়ে পড়েছে। চিৎকার দিচ্ছিস আর কাঁপছিস। তোর বাবা আমি দু’জনে বুকে কপালে হাত দিয়ে ঝাঁকালাম। তারপর বন্ধ হলো তোর চিৎকার। কিন্তু চিৎকার বন্ধ করে ঘুমিয়েই থাকলি। যত ডাকি তোর ঘুম আর ভাঙে না। অনেকক্ষণ পরেইতো চোখ খুললি।
ওর আম্মু বললেন- বাবা তোমার আর একা থাকা চলবে না। কি হয়েছে তোমার জানি না। কিন্তু তুমি এত ভয়ের ভেতর কেন আছ? কেন এত মৌন হয়ে থাকো! আমাদের সাথেই ঘুমাবে তুমি। চলো। ওঠো। আর দেরি নয়। বলেই মাথার নিচে হাত দিয়ে তুলে নিলেন ছেলেকে। দুজনে ধরে নিয়ে গেলেন নিজেদের রুমে। তিনজন অনায়াসে এ খাটে ঘুমানো যায়। মাঝখানে ছেলে দুপাশে বাবা মা দু’জন। লাইট অফ করে ঘুমিয়ে গেলেন বাবা মা। ঘুম নেই শুধু ফারজাদের চোখে। অন্ধকার যেনো কাতুকুতু দিচ্ছে ওকে। ঘুম যেনো উড়ে গেছে চোখ থেকে। ভাবছে চিৎকার দিলো কখন ও। কেন চিৎকারটা দিলো। কোনো ভয়ঙ্কর স্বপ্ন কি দেখেছিলো? কিছুই মনে পড়ছে না। কিছুই না। ও যে চিৎকার দিয়েছে তাও তো জানে না ও। চিৎকার যে দিয়েছে এটা তো সত্যি। আব্বু আম্মু ছুটে গেছেন চিৎকার শুনেই তো। নিজে নিজেই লজ্জা পাচ্ছে। ও এত বড় হয়েছে। সবাই সাহসী বলে। অথচ ঘুমের ঘোরে চিৎকার দিয়ে ছাদ ফাটিয়ে ফেলার তো মানে হয় না। বিষয়টি কি! কেন এমন পরিস্থিতির শিকার ও।
হঠাৎ এক ধরনের গুনগুন মতো শব্দ হলো। কোন্ দিকে হলো? বোঝার চেষ্টা করছে। কান খাড়া করলো ও। না আর শোনা যাচ্ছে না। বোধয় মনের ভুল। মনের ভেতর ভয় যখন বাসা বাঁধে তখন অকারণ শব্দ শোনা যায়। ওর অবস্থাও তো তাই- ভাবে ফারজাদ।
একটু ঘুমাতে পারলে ভালো লাগতো। ঘুমতো চোখের ধারে কাছে নেই। কোথায় যে পালালো। ওর টিচার বলেছেন ঘুম না এলে ১০০ সংখ্যাটিকে উল্টো করে গুনতে। গুনতে হবে মনে মনে। ও এখন গুনছে- ৯৯, ৯৮, ৯৭, ৯৬, ৯৫…। আবার সেই গুনগুনানী। আবার কান খাড়া করলো ও। আগের চেয়ে একটু জোরেই শোনা গেলো।
ভয়ের নদী বয়ে গেলো ওর শরীরে। টিচারের কথা মনে পড়তেই ভেসে উঠলো সেই ভয়ঙ্কর চোখ। তারওপর গুনগুন শব্দের খেলা। ওহ্ কি যে হলো আল্লাহই জানেন। আবার নিঃশব্দ রাত বয়ে যাচ্ছে। বয়ে যাচ্ছে ভোরের দিকে। কিন্তু ভোর হতে এখনো দেরি আছে। বাবা মার মাঝখানে থেকেও ভয়ে গা ছমছম। ঘুম বোধয় এবার পালিয়েই গেলো।
আবার উল্টো করে সংখ্যা গোনা শুরু। আবার ঘুমানোর চেষ্টা। গুনতে গুনতে একের ঘরে চলে এলো। নাহ্ ঘুমের নাম নিশানাও নেই। এবার দোয়া দরুদ পাঠ। যত সূরা মুখস্থ ছিলো সব পড়ছে। তাও আসে না ঘুম।
গুনগুন শব্দ এবার বেশ শব্দ করেই শোনা গেলো। বালিশ থেকে মাথা তুলে বোঝার চেষ্টা করছে। ওর মনে হলো শব্দটা জানালার দিকে থেকে হলো। জানালা খোলা। বারবার দেখে জানালার দিকে। বাইরের খানিকটা সাদা অন্ধকার ভেসে আছে জানালার বুকে। চোখ গেলো আরো দূরে। আকাশের কিছু অংশে। তখন আকাশ তারায় তারায় ছেয়ে আছে। ওর মনে হচ্ছে রূপালি ফুল ফুটে আছে আকাশের গায়ে। আহা তারার দেশে যদি যাওয়া যেতো। হাঁটা যেতো তারাবনে। কি মজাইনা হতো। তারার খানিক আকাশ ওকে অন্য ভাবনায় ডুবিয়ে দিলো। ভালোও লাগছে আকাশের কথা ভাবতে।
ওর মনে পড়ছে হেমন্ত রাতের কথা। গ্রামের বাড়িতে হেমন্তের গভীর রাতে উঠানে দাঁড়াতো। একা। সারা আকাশে রূপালি তারার মেলা। কি প্রশান্তিময়! কি আনন্দময়! আকাশ দেখায় এত আনন্দ কে জানতো। ও জেনেছে। জেনেছে নিজে নিজেই। মধ্যরাতের আকাশ দেখতে কেমন এমন কৌতূহল থেকেই জেনেছে। তারপর বহুদিন বহুবার আকাশ দেখেছে। দেখে দেখে ভেবেছে আকাশের রহস্য নিয়ে। তারার রহস্য নিয়ে। এবং অন্ধকার নিয়ে।
আবার গুনগুন। সেই সাথে ধুপধাপ শব্দ। ওর মনে হলো ওর মাথার ওপরই শব্দটা হলো। চারপাশের দেয়াল দেখে নিলো। নিচে মেঝের খালি অংশটাও দেখলো। কিছুইতো নেই। তবে শব্দটা যে রুমের ভেতরে হচ্ছে ও নিশ্চিত। তাহলে কোথায় হচ্ছে! নাকি ওর মনের কোনো অজানা ভয় থেকে শুনছে কে জানে। ভালো করে দেখে নিলো জানালা, চার দেয়াল। নাহ। সবই যেনো ঘুমের ঘোরে অচেতন। জেগে নেই কিছুই। তবে ওর মনে হচ্ছে তারাগুলো ওর মতো জেগে আছে। আচ্ছা তারারা কি কখনো ঘুমোয়? নিজেকে প্রশ্ন করে নিজেই। জবাবও দেয়- নাহ্ তারা কখনো ঘুমায় না। ঘুমালে এত মিটি মিটি হাসি হাসবে কি করে। ভাবতে ভাবতে দৃষ্টি সরে এলো ছাদে। রুমের ছাদে যেনো আঁধার জমে আছে। এ রুমটা বাসায় সব চেয়ে বড় রুম। রুমের ছাদটাও বড়।
ছাদে চোখ ঘুরিয়ে আবার জানালার দিকে ঘোরায়। দৃষ্টি জানালার ওপরে বাঁ পাশের কোনার ছাদে দৃষ্টি
No comments:
Post a Comment