Monday, August 17, 2015

ঝাউদীঘির আতঙ্ক [শেষ অংশ]

facebook.com/dor8920.abcকক্ষের বিশাল জানালা দিয়ে হু হ করে চৈত্ররাতের বাতাস ঢুকলেও আমার ভীষণ গরম লাগছিল। পায়জামা পরে খালি গায়েই ছিলাম। বেশি গরম লাগলে নীচে নেমে দীঘির জলে সাঁতার কেটে আসব বলে ঠিক করলাম। লিখলাম … প্রাথমিক ভাবে আমার ইনামগড়ের জমিদারবাড়ির এরিয়া প্রায় ছয় একর বলে মনে হয়েছে। অবশ্য কম হতে পারে আবার বেশিও হতে পারে। সবচে উল্লেখযোগ্য যেটা, লেবুবাগানে বৌদ্ধদেবী তারার একটি ছোট্ট মন্দির রয়েছে।মন্দিরটি সন্দেহ নেই পাল আমলের নির্মিত। কাজেই প্রায় হাজার বছরের পুরনো হওয়ার কথা। এটা একটা অনন্য ডিসকভারীই বলা যায়। তবে কিছু প্রশ্ন জাগে … টাইপ করতে করতে মনে হল আকাশ থেকেফুটফুটে জ্যোস্না ঝরছে। অলিন্দে দাঁড়ালে দেখতে পাব চৈত্রপূর্ণিমার পূর্র্ণযৌবনা চাঁদ আর ঝাউদীঘির টলটলে রূপালি জল । বেশ বুঝতে পারছি যে আজ রাতে আমার আর ঘুম আসবে না। না হোক। কত রাতই তো আমার বই পড়ে কেটেছে। দূরথেকে হুইশিলের আওয়াজ ভেসে এল। কুউউউ ঝিকঝিক। মাঝরাতের ট্রেন। স্টেশনমাস্টার রফিক উদ্দীন সরকারের মুখটা মনে পড়ে গেল । ভদ্রলোক যদি জানতেন যে আমি এই মধ্যরাতে জমিদার হেমেন্দু বিকাশরায় চৌধুরীর শয়ন কক্ষে বসে আছি এবং ঝাউদীঘির টলটলে রূপালি জলে উদোম হয়ে সাঁতার কাটার প্ল্যাট আঁটছি … আমি লিখছিলাম … সেনআমলে সেনরাজাগণ বৌদ্ধদের ওপর প্রচন্ড দমনপীড়ন চালিয়েছিলেন । তাহলে লেবুবাগানের ওই বৌদ্ধমন্দিরটি কি ভাবে আজও ইনট্যাক্ট রয়েছে? এই বিষয়টির গ্রহনযোগ্য ব্যাখ্যা কি? এই পর্যন্ত লিখলাম। আসলে ইতিহাসএবং প্রত্নতত্ত্ব হল অনেকটা গোয়েন্দা কাহিনীর মতো । অনেক প্রশ্ন উঠে আসে। তখন মাথায় জট পাকিয়ে যায় । সিগারেট টানতে টানতে পায়চারি না করলে আমার আবার মাথার জট খুলে না। আমি দিনের বেলায় ধূমপান থেকে বিরত থাকি। রাতের হিসেব অবশ্য অন্যরকম। মালবোরোর সাদা প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে ধরালাম। তারপর উঠে অলিন্দে চলে এলাম। মার্চরাত্রির স্নিগ্নধবল জ্যোস্নায় ভীষন মুগ্ধ হয়ে গেলাম। ঝাউগাছের পাতা ছুঁয়ে মধুর চৈত্র বাতাস ছুটে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরল।মুহূর্তেই আমি পুরনো ইতিহাসের গূঢ় জিজ্ঞাসার কথা ভুলে গেলাম । প্রকৃতির মধ্যে ডুবে যেতে লাগলাম। প্রকৃতি ঘুমিয়ে পড়েছে। কী নির্জন চরাচর! কেবল একটি রাতচরা পাখি কর্কস কন্ঠে ডেকে গেলে সে অটুট নির্জনতা ক্ষণিকেরজন্য ভেঙে পড়ল। তাকিয়ে দেখলাম ঝাউদীঘির রূপালি জলে কাঁপন উঠেছে। মাছ নিশ্চয়ই। আজ যে রুইমাছ খেলাম ওই দীঘিরই বোধহয়। ওসমান গাজী ধরে রেখেছিল। আমি যে আসছি সে তো ওসমান গাজী জানতই । ঝাউদীঘির পানি থেকে একটা মাথা ভেসে উঠল। মানুষের মাথা। আমার শরীর আতঙ্কে হিম হয়ে গেল। মাথাটা ধীরে ধীরে ঘাটে এসে ঠেকল । তারপর ধীরে ধীরে উঠে এল। জলে ভেজা শরীরের পরনে ছেঁড়া লুঙ্গি আর গেঞ্জি। এক হাতে একটা কোদাল। অন্য হাতে টুকরি। সে মুখ তুলে দোতলার অলিন্দের দিকে তাকাল। আমি আমূল কেঁপে উঠলাম। আমার হাত থেকে সিগারেট খসে পড়ল। ঝাউদীঘির মৃত মাটি-কাটিয়ে মজুর? কিন্তু কিন্তু তা কি করে সম্ভব? ততক্ষণে দীঘির পানিতে আরও অনেক মাথা ভেসে উঠে। আমি কি ভুল দেখছি? আমার কি হ্যালুসিনেশন হচ্ছে? অবচেতন মনে কে যেন তাড়া দিল। আমি দিগবিদিগ দৌড়ে নীচে চলে এলাম। অন্ধকারে বেশ ক’বার ঠোক্কর খেলাম। অবশ্য যন্ত্রণা টের পেলাম না। আমার শরীর ভীষন কাঁপছিল। ওসমান গাজী ! ওসমান গাজী ! আমার মুখে কথা ফুটল না। ওসমান গাজী টিনসেড থেকে বেড়িয়ে এল। বলল, হজুর জলদি গাড়িতে উঠেন।বলেই এক লাফে জুরীগাড়িতে চড়ে বসল ওসমান গাজী। আমিও দরজা খুলে ভিতরে বসতে দেরি করলাম না । থরথর করে কাঁপছিলাম। ঘামে শরীর ভিজে গেছে। জ্যোস্নামাখা লেবুবনের মাঝখান দিকে ঘোড়াগাড়ি ছুটছে। দু’পাশের লেবুগাছগুলি ভীষন কাঁপছিল। অশুভ আত্মার তপ্ত নিঃশ্বাস টের পাচ্ছিলাম যেন। দেখতে দেখতে জুরীগাড়ি শালজঙ্গলে উঠে এল। ঘোড়া দুটি ভীষণ চিঁ হি চিঁ হি করছে। ওরাও ভয় পেয়েছে। দু’পাশের শালজঙ্গলেওযেন ঝড় উঠেছে। ভয়ানক শনশন আওয়াজ হচ্ছে । গাছগুলি দুমড়ে-মুচড়ে যাচ্ছিল। জুরীগাড়ি একবার কী সেরধাক্কায় ভয়ানক কেঁপে উঠল। ওসমান গাজী প্রাণপন চেষ্টা করে তাল সামলালো। তারপর কখন যেন রেলস্টেশনের সামনে জুরীগাড়িটা থামল ওসমান গাজী । নামেন হুজুর। আর কোনও ভয় নাই। আমি দরজা খুলেই এক লাফে নীচে এলাম। তারপর ছুটে গেলাম স্টেশনমাস্টারের ঘরের দিকে। স্টেশনমাস্টার রফিক উদ্দীন সরকার ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন। সিগারেট ফুঁকছিলেন। আমাকে দেখেই বললেন, বুঝেছি। বড় বাঁচা বেঁচে গেছেন। যাক। আধঘন্টা পরেই ঝিকড়গাছার একটি ট্রেন আছে। সেই ট্রেনে আপনাকে তুলে দেব। এখন আমার ঘরে আসুন। কিছু একটা পরে নিন। (সমাপ্ত)


No comments: